Wednesday, May 27, 2015

মালেশিয়া ভ্রমন - ৩ : কুয়ালালামপুর ( প্রথম দিন ) | KLIA2, KL Sentral, Jalan Ampang

KLIA2 plane ground

কুয়ালালামপুরে যখন পৌছলাম তখন স্থানীয় সময় ভোর সাড়ে পাঁচটা। রাত জাগা আমার স্বভাববিরুদ্ধ কাজ, তবু পুরো ফ্লাইটের সময়টায় জেগে থেকে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। ঢুলু ঢুলু চোখে প্লেন থেকে নেমে ভারী ব্যাকপ্যাকটা কাঁধে নিয়ে করিডোর ধরে এগিয়ে সিড়ি দিয়ে এরাইভাল হল এসে পৌছলাম। অনাকাঙ্খিত ভাবে সেখানে চার পাঁচ জনের একটা ইমিগ্রেশন পুলিশের দলকে কড়া মুখ-চোখ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। আমাদের ফ্লাইটের প্রত্যেক যাত্রীকে পথ আগলে পাসপোর্ট চেক করতে শুরু করলো। যারা প্রথমবারের মত মালেশিয়ায় এসেছে তাদের পাসপোর্টটা রেখে দিয়ে সবাইকে একপাশে লাইন করে দাড় করিয়ে দিলো। স্বাভাবিকভাবে আমিও এদের দলে পড়ে গেলাম, আর আশু মহাঝামেলার অপেক্ষা করতে লাগলাম।

ভীনদেশী পর্যটকরা যখন সামনে দিয়ে যাচ্ছিলো তখন এই জনা পঞ্চাশেক নারী-পুরুষ-শিশুকে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অবাক হচ্ছিলো। বিদেশ ভ্রমনে বের হলে প্রথম প্রথম অবশ্যই মনে হবে যে, বাংলাদেশী হয়ে জন্মানোটা কতটা অসম্মানজনক। যদিও আমি বিশ্বাস করি আমাদের এই অসম্মানজনক জীবনের জন্যে আমরা দায়ী নই, বরং আমাদের নেতারাই দায়ী। মালেশিয়া, ইউএসএ কিংবা ইউকে তে গেলে আপনি দেখতে পাবেন দেশের সম্পদ চুরি করে এদেশের মন্ত্রী-এমপি আর আমলা কি পরিমান সম্পদ জমা করেছে। আমাদের সম্পদ আমাদের মধ্যে সমান / যৌক্তিকভাবে বন্টন না করে নিজেরা খেয়ে দেয়ে ফুলে ফেঁপে গিয়েছে। বাংলাদেশের এম্বাসীগুলো প্রবাসে থাকা বাংলাদেশীদের কে সামান্য সহায়তা তো দুরে থাক পারলে দুর দুর করে তাড়িয়ে দেয়। যে দেশের মানুষ তাদের নেতা আর আমলাদের কাছ থেকেই অত্যাচারের শিকার হয়, সেদেশের মানুষের প্রতি অন্য কোন দেশ কখনোই সম্মান দেখাবে না।

লাাইন ধরে ইমিগ্রেশন পুলিশের পেছন পেছন একটা ঘরের কাছে এসে দাঁড়ালাম। ঘরটিতে বসার ব্যবস্থা রয়েছে, তবে এত মানুষের জন্যে যথেষ্ট নয়। তাই অর্ধেকের মত যাত্রী বাইরে দাঁড়িয়ে থাকলো আর বাকি অর্ধেক ভেতরে বসার সুযোগ পেলো। অনেকক্ষন পর ডাক এলো, কাউন্টারে মহিলা একজন অফিসার বসে ছিলেন, তিনি আমার পাসপোর্টটা চেক করলেন, আর ভ্রমনের কারন জানতে চাইলেন। সাথে কত ডলার নিয়ে এসেছি এবং কোথায় কোথায় যাবো ও কতদিন থাকবো তাও জানতে চাইলেন। তারপর রিটার্ন টিকেট দেখে ছেড়ে দিলেন। ইমিগ্রেশন পার হয়ে বেরুতে বেরুতে সাতটা বেজে গেলো। কুয়ালা লামপুরে সূর্যোদয় হয় সাতটার একটু পরে, তাই ফ্রেশ হয়ে ওজু করে নিয়ে নামাজের একটা ঘরে ঢুকে পড়লাম, ফজরের নামাজ আদায় করে কিছুক্ষন বসে রইলাম, সারাটা দিন হাতে রয়েছে এবং আজকের দিনের জন্যে আমার কোন পরিকল্পনা নেই। তাই কিছুক্ষন কোরআন শরীফও পড়ে সময় কাটানোর চেষ্টা করলাম। মালেশিয়ায় এলে আপনাকে অবশ্যই কিছু জরুরি মালেশিয়ান ভাষা শিখে নিতে হবেে, যেগুলো বিভিন্ন জায়গায় বেশ কাজে দেবে। মালেশিয়ানরা ইংরেজী বর্নমালা ব্যবহার করে কিন্তু ইংরেজী ভাষা খুব বেশি ব্যবহার করে না। বিভিন্ন সাইনবোর্ডে মালেশিয়ান ভাষাতেই সব কিছুর ডিরেকশন দেয়া থাকে। টয়লেট, নামাজের জায়গা কিংবা প্রবেশ/প্রস্থানের রাস্তা'র মালেশিয়ান শব্দ গুলো জেনে রাখা উচিত। নিচে কয়েকটি শব্দের মালায় ভাষায় অর্থ দিয়ে দিলাম:

১. টয়লেট: Tandas
২. নামাজের জায়গা: Surau
৩. বাহির: Keluar

Shaheed at KLIA2


KLIA2 একটা বেশ বড় এয়ারপোর্ট। এর তিনটি অংশ রয়েছে। প্রথম অংশটিকে বলা হয় "ট্রান্সপোর্টেশন হাব", চারতলা বিশিষ্ট এই অংশ রয়েছে কার পার্কিং, বাস ট্রান্সপোর্ট, ট্রেইন ট্রান্সপো্র্ট (KLIA Express) এবং রাত্রী যাপনের জন্যে হোটেল। দ্বিতীয় অংশটিকে বলা হয় "গেটওয়ে", এখানে পাবেন দেশি বিদেশী বিভিন্ন ব্রান্ডের পোষাক, ইলেক্ট্রনিক্স পন্য, চকলেট, খাবার দোকান ইত্যাদি। মালেশিয়ায় শপিংএ এলে ভুলে কেনেননি এমন জিনিসগুলো এখান থেকে কিনে নিতে পারবেন। টার্মিনাল থেকে বেরিয়ে গেটওয়েতে ঢুকতেই মোবাইল ফোনের সিম কার্ড ও রিচার্জ করে নেবার দোকান পেয়ে যাবেন। বন্দরের তৃতীয় অংশটির নাম হলো "টারমিনাল", এরাইভাল, ডিপার্চার ও ইমিগ্রেশন সবকিছু মিলে টারমিনাল বিল্ডিং।

সময় হাতে আছে, তাই এয়ারপোর্ট টা বেশ আয়েশ করে কয়েকবার ঘুরে দেখলাম। রাতে না ঘুমানোয় একটুখানি ক্লান্তি লাগছিলো, আর সকাল বেলা ক্ষুধাটাও একটুখানি দুর্বল করে দিচ্ছিলো। একলা একলা রেস্টুরেন্টে যাবার অভিজ্ঞতা আমার নেই বললেই চলে, সত্যি বলতে খাবার কেমন করে অর্ডার করতে হয় সে বিষয়ে আমার অভিজ্ঞতা খুবই কম। বন্ধুদের মতে বিদেশ গেলে আমি শুধুমাত্র খাবার কিনতে না পেরে ক্ষুধায় মারা যাবো। ওদের সকলের ভবিষ্যদ্বানীকে ভুল প্রমান করে একটা রেস্টুরেন্টে খাবারের অর্ডার করে ফেললাম। আন্দাজে ছবি দেখিয়ে একটা খাবারের অর্ডার করেছি, খাবার যেটা আসলো সেটা দেখে চোখ চড়কগাছ হয়ে গেল। ছোট্ট একটা কি যেন দিলো, আর এত্তোগুলো টাকা নিয়ে গেলো। খেয়ে যে কিছুতেই পেট ভরবে না তাতে শিওর হয়ে আস্তে আস্তে খেতে লাগলাম।

বিমান বন্দর থেকে কুয়ালালামপুর সিটি সেন্টার প্রায় ৫৫-৬০ কি.মি. দুরে। বন্দরের ট্রান্সপোর্টেশন হাব থেকে পছন্দ মত যেকোন একটি বাহনে করে আপনি শহরের কেন্দ্রে পৌছে যেতে পারেন। সবচে দ্রুতগামী বাহন হলো ট্রেন যা "KLIA Express" নামে পরিচিত। এটি মাত্র ২৮ মিনিটে আপনাকে পৌছে দেবে  "KL Sentral" (শহরের কেন্দ্রে) এ। এ পরিবহনে আপনার খরচ হবে প্রায় ৩৫ রিঙ্গিত। এছাড়া আছে ট্যাক্সি, যা সবচে খরচবহুল পরিবহন। আপনি যদি নিজে ড্রাইভ করতে পারেন তবে বন্দরের নির্দিষ্ট কাউন্টার থেকে "এয়ার এশিয়া"র রেন্ট-এ-কার সার্ভিস থেকে একটা গাড়ি ভাড়া করে নিতে পারেন। সেক্ষেত্রে ৬, ১২ ঘন্টা বা ২৪ ঘন্টার জন্যে আপনি খুব সস্তায় গাড়ি ভাড়া করতে পারবেন। যদি জরুরি কাজ সেরে ঐদিন বা তার পরদিন বিমান বন্দরে ফেরত আসার পরিকল্পনা থাকে শুধু সেক্ষেত্রেই এই পরিবহন ব্যবস্থাটি আপনি গ্রহন করতে পারেন। এছাড়া সবচে কম খরচের পরিবহন ব্যবস্থা হল বাস। বাস ভাড়া প্রতি জনের জন্যে ১০ রিঙ্গিত, রাউন্ডট্রিপ ভাড়া মাত্র ১৬ রিঙ্গিত। বাসে সময় লাগবে ১ ঘন্টার কিছুটা কম। বন্দরের সবচে নিচ তলায় বাসের টিকেট কাটা যায়, সেখানকার গেট দিয়ে বেরুলেই বাসকে অপেক্ষমান দেখতে পাওয়া যাবে। ২৪ ঘন্টাই এ সার্ভিস চালু থাকে, প্রতি ১০ থেকে ১৫ মিনিট পর পর বাস ছাড়ে বন্দর থেকে।

বাস স্টেষন, KLIA2
বাসে করে KL Sentral এ আসতে প্রায় পঞ্চাশ মিনিটের মত সময় লাগলো। বাসে খানিকটা ঘুমিয়ে নিলাম, বাকিটা সময় আদনানের সাথে আড্ডা দিয়ে কাটিয়ে দিলাম। সৌভাগ্যক্রমে আদনান সেই সকালেই জরুরী কাজে কুচিং থেকে কুয়ালালামপুর এসেছে, আমি যখন নাস্তা করতে বসেছি ঠিক তখনই ও প্লেন থেকে নেমে আমার সাথে দেখা করে। তারপর থেকে সারাদিন ওর সাথেই ছিলাম।


KL Sentral জায়গাটা অনেকটা আমাদের ফার্মগেট কিংবা গুলিস্তানের আধুনিক ভার্সন। এখান থেকে কুয়ালা লামপুর বা মালেশিয়ার যেকোন জায়গায় যাওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। বিভিন্ন ধরনের পরিবহনের কেন্দ্রীয় স্টেষন এটি, এখান থেকেই সব গাড়ি, ট্রেন বিভিন্ন গন্তব্যের দিকে চলে যায়। বিমান বন্দরের মত এটিও অনেকগুলো তলায় ও অংশে বিভক্ত। বিভিন্ন তলায়, বিভিন্ন অংশে বিভিন্ন ধরনের পরিবহনের স্টপেজ ও টিকেট কাউন্টার রয়েছে। আর মাঝে পুরোটা একটা বহুতল মার্কেট, এখানেও বিভিন্ন ব্রান্ডের খাবার দাবার ও পোষাক আষাকের দোকান রয়েছে।

Adnan at KL Sentral

আমি যেমন তেমন টাইপ একটু নাস্তা করলেও আদনানের নাস্তা করা হয়নি। তাই KL Sentral এর গ্রাউন্ড ফ্লোরে চলে গেলাম যেখানে অনেক ব্রান্ডের খাবার দাবার পাওয়া যায়। ম্যাকডোনাল্ডস এর হ্যাপি আউয়ার ধরার টার্গেট নিয়ৈ সেখানে ঢুকে পড়লাম, বার্গার আর কফি দিয়ে সকালের নাস্তাটা শেষ পর্যন্ত পরিপূর্ণ হলো।


আজকের দিনের জন্যে আসলে আমার কোন পরিকল্পনা ছিলো না। সন্ধায় বন্ধুরা কুচিং থেকে এসে পৌছাবে। সারাটা দিন কোন রকমে পার করে দিতে পারলেই বাঁচি। আদনানের জরুরী কাজগুলোয় সঙ্গী হবো, দুপুরে হোটেলে চেকইন করে একটা ঘুম দেব এটাই আপাতত পরিকল্পনা। আদনানকে Ampang Park এ একটা ট্রাভেল এজেন্সীর অফিসে যেতে হবে। KL Sentral থেকে LRT (রেল ট্রান্সপোর্ট) এ করে সেখানে যাওয়া যাবে। স্বয়ংক্রিয় কাউন্টার থেকে LRT এর টোকেন কিনতে পাওয়া যায়। ATM মেশিনের মত যন্ত্রটিতে আপনি টাকার নোট একটা একটা করে ঢুকিয়ে দিতে হয়, নির্ধারিত ভাড়া টুকু রেখে সে বাকি টাকা ফেরত দিয়ে দেবে, আর সাথে দেবে একটা টোকেন।



এই টোকেনটি মেশিন রিডেেবল, LRT এর প্লাটফরম এ ঢোকার সময় গেটে এটি স্ক্যান করে প্রবেশ করতে হয়, আবার যে জায়গায় যাবার জন্যে টোকেনটি নেয়া হয়েছে ঠিক সেই জায়গার প্লাটফরমের বের হওয়ার গেটে এটি স্কান করেই কেবল বের হওয়া যাবে। অন্য কোন স্টেশনে স্ক্যান করা হলে তাতে গেইটের দরজা খুলবে না।  LRT তে বসার কোন ব্যবস্থা নেই। সব যাত্রীকেই দাড়িয়ে দাড়িয়ে ভ্রমন করতে হয়।

Inside LRT
আম্পাঙ পার্ক একটা কমারশিয়াল এলাকা। এখানে বড় অফিস আদালত ছাড়াও আরো রয়েছে খুব দামী দামী কিছু পাঁচতারা হোটেল, এবং পেট্রোনাস টুইন টাওয়ারও এখানেই অবস্থিত। এখানকার রাস্তায় উঁচু উঁচু দালানকোঠা দেখা যায়, নিরিবিলি রাস্তায় খুব বেশি ভীড় নেই। সাজানো গুছানো রাস্তায় প্রথমে হাটতে খুব ভাল লাগলেও কিছুক্ষনের মধ্যেই তৃষ্ণায় গলা ফেটে যেতে চাইলো। ত্রিশের বেশি তাপমাত্রার সাথে এখানকার বাতাস প্রচন্ড জলীয় বাষ্পে ভরা। এতে খুব তাড়াতাড়ি শরীর প্রচন্ড ঘামিয়ে যায়, আর তৃষ্ণার তৈরী হয়।

Jalan Ampang, Kuala Lumpur

আদনানের কাজ শেষ হবার পর বুকিত-বিনতাংয়ে চলে এলাম, সেখানে আমাকে হোটেলে পৌছে দিয়ে আদনান চলে গেল। গোসল করে ফ্রেশ হয়ে বিছানায় শুতেই ঘুম চলে এল। বিকেলের দিকে আদনানের ফোনে ঘুম ভাঙলো, হোটেল থেকে বেরিয়ে আদনানের সাথে একসাথে একটা বাংলাদেশী রেস্টুরেন্টে ভাত খেলাম, তারপর হোটেলে ফিরে গিয়ে আবার এক ঘুম। সন্ধায় ঘুম থেকে উঠে মাগরিবের নামাজ পড়ে কম্পিউটার নিয়ে বসতে না বসতেই কুচিংয়ের বন্ধুরা হাজির হয়ে গেল।

এশার নামাজের পর রাতের খাবার আর হাটাহাটির জন্যে বের হলাম সবাই। বের হতেই দেখি বৃষ্টি পড়ছে। কুয়ালা লামপুরে সাধারনত প্রতিদিনই অল্পবিস্তর বৃষ্টি হয়ই। এখানকার বৃষ্টির ধরন হলো এখানে ঝপঝপ করে বৃষ্টি তেমন হয়না, বরং ঝিরিঝিরি করে অনেকক্ষন বৃষ্টি হয়ে আস্তে আস্তে থেমে যায়। দিনে, সন্ধায় কিংবা রাতে কোন না কোন এক সময় বৃষ্টি হবেই। বুকিত বিনতাং এর রাস্তার পাশে তুর্কী একটা রেস্টুরেন্টে রাতে খাবার খাওয়া হলো।
তুর্কি রেস্তোঁরার খাবার দাবার




রেস্টুরেন্ট থেকে যখন বেরোই তখনও ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছিলো। বুকিত বিনতাং থেকে পেট্রোনাস টুইন টাওয়ার খুব কাছেই। হেটে দশ মিনিটের মধ্যেই সেখানে পৌছে যাওয়া যায়। বৃষ্টির কারনে ট্যাক্সি নেয়া হলো, এখানকার রাস্তাগুলো বেশিরভাগ একমুখী হওয়ায় অনেকটা ঘুরে সেখানে যেতে হলো। পেট্রোনাস টুইন টাওয়ারের নিচ তলায় একটা মার্কেট রয়েছে,  "Suria KLCC" এর ভেতর খানিকটা ঘোরাঘুরি করে টাওয়ারের চত্বরের সামনে এসে দাঁড়ালাম। তখনো বৃষ্টি পড়ছিলো। আকাশে মেঘ আর চারপাশের উঁচু বিল্ডিংগুলো মিলে চমতার একটা ল্যান্ডস্কেইপ তৈরি হয়েছে। এ যেন ইট-পাথরের কোন প্রাকৃতিক দৃশ্য।


পেট্রেনাস টুইন টাওয়ার অনেক দিন পর্যন্ত পৃথিবীর সবচে উঁচু বিল্ডিং হিসেবে পরিচিত ছিলো। জীবনে প্রথমবারের মত শ'য়ের বেশি তলার কোন বিল্ডিং দেখলাম। যদিও বৃষ্টি আর মেঘের জন্যে ভাল ভাবে দেখতে পারছিলাম না। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না, পোস্টার আর ছবিতে দেখা এই জাদুকরী বিল্ডিং আমি নিজ চোখে দেখছি, হাত দিয়ে ছুয়ে দেখছি, আর চারপাশে ঘোরাঘুরি করছি।





Jalan Ampang এর রাস্তায় প্রায় আরো একঘণ্টা হাঁটাহাঁটি শেষে হোটেলে ফিরে গেলাম। তারপর ঘুম।
পেট্রোনাস টুইন টাওয়ারের প্রবেশ পথে, ছবিতে বাঁ দিক হতে- মুনতাসীর রশিদ, শাহিদ, ইমরান ও সিয়াম

Tuesday, May 26, 2015

মালেশিয়া ভ্রমন - ২: প্রস্থান (শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর)

Shahjalal International Airport ( Photo Credit: Nahid Sultan )
আমি যেখানে থাকি সেখান থেকে খুব কাছেই ঢাকার একমাত্র বিমান বন্দর। জীবনে প্রথমবারের মত কবে যে সেই বিমান বন্দরে গিয়েছিলাম সময়টা মনে করতে পারছিনা। ছোটবেলা থেকেই অনেক বার আমাকে সেখানে যেতে হয়েছে। তবে কখনোই বিমানে চড়ার জন্যে নয় বরং গ্রাম থেকে আসা আত্নীয়দের কে "বিমান বন্দর" জিনিসটার সাথে পরিচয় করিয়ে দেবার জন্যে কিংবা তাদের বিদেশ যাবার সময় তাদেরকে এগিয়ে দেবার জন্যে বারবার সেখানে গিয়েছি।

২০১৩ সালে নেপাল যাবার সময় প্রথমবারের মত বিমান বন্দরটিকে সত্যিকার ভাবে উপভোগ করেছি। আমাদের এই বিমান বন্দরটা মাঝারি সাইজের একটা বিমান বন্দর, দুইটা আন্তর্জাতিক টারমিনাল আছে এখানে, আরেকটা ডোমেস্টিক টারমিনাল আছে। দ্বিতীয় টারমিনাল ভবনটি অপেক্ষাকৃত নতুন, কয়েক বছর আগে এটি তৈরী হয়েছে এবং নতুন আরো একটি টারমিনালের কাজ শুরু হবে কিছুদিনের মধ্যে। ১৯৮০ সাল থেকে পুরোদমে চালু হওয়া এই এয়ারপোর্টের নামকরন হয়েছিলো শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের নামে। তাঁর নামানুসারে বন্দরের নাম ছিলো "জিয়া আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর"। বর্তমান ক্ষমতাসীনদের নামকরনের রাজনীতির চাপে পড়ে প্রায় চৌদ্দশ কোটি টাকা খরচ করে এর নতুন নামকরন হয়েছে। বাংলাদেশ অঞ্চলের অন্যতম ধর্মপ্রচারক শাহজালাল (রহ:) এর নামে বিমান বন্দরের নতুন নাম হয়েছে "শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর"।

মালেশিয়া যাবার জন্যে "মালিন্দো এয়ার" এর টিকেট কেটেছি। এটি সবচে কম খরচে যাত্রীদেরকে কুয়ালা লামপুর পৌছে দেয়। প্রথমবার মালেশিয়া যাবার জন্যে এটি একটি ভুল পছন্দ ছিলো। প্রথমবার মালেশিয়া যাবার সময় "বিমান বাংলাদেশ" অথবা "মালেশিয়ান এয়ার" এর টিকেট কাটা উচিত। এ দুটি বিমান KLIA 1 এ নামে, এটি মালেশিয়ার পুরোন আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর, আন্তর্জাতিক যাত্রীদের ব্যাপারে তারা আগে থেকেই অভ্যস্ত, যাত্রীর জন্যে ঝামেলা কম। অপরদিকে মালিন্দো নামে KLIA 2 তে, এই বিমান বন্দরটি মালেশিয়ার ডোমেস্টিক বন্দর হিসেবে বেশি ব্যবহৃত হয়েছে, আন্তর্জাতিক যাত্রীদের ব্যপারে তাদের অভিজ্ঞতা কম হওয়ায় অনেক যাত্রীই বেশ ঝামেলায় পড়ে যেতে পারেন। তবে, আপনার মালেশিয়ায় যাওয়ার কারনটি যদি যৌক্তিক হয়, আর আপনি যদি কনফিডেন্ট থাকেন তবে প্রথমবার ভ্রমনে এটা কোন সমস্যাই না। অল্প বাজেটে ভ্রমনের স্বার্থে অভিজ্ঞদের পরামর্শ উপেক্ষা করেই মালিন্দোর টিকেট কিনে ফেলেছিলাম।

মালিন্দোর বিমানটি ছাড়ে রাত ১১ টার সময়। প্লেন ছাড়ার কমপক্ষে আধঘন্টা আগে আপনাকে চেক ইন করতে হবে, এবং লাগেজ চেকইন করাতে হবে (যদি থাকে)। তবে চেকইন শুরু হয় যাত্রার তিনঘন্টা আগে থেকেই। ঢাকার যেই ট্রাফিক জ্যাম কন্ডিশন তাতে যাত্রার সময়ের কমপক্ষে তিনঘন্টা আগে বাসা থেকে বের হওয়া উচিত। যদিও রাত নয়টার পর রাস্তা বেশ ফাঁকা থাকে আর আমার বাসাও বন্দর থেকে খুব বেশি দুরে নয়, তাই একটু দেরী করে বেরুলেও আমার জন্যে সমস্যা হতো না। তারপরও একলা একলা প্লেনে ভ্রমন এটিই প্রথম, তাই কোন রিস্ক নিতে চাইলাম না, একটু আগে আগেই বেরিয়ে গেলাম। সাড়ে আটটা নাগাদ বিমান বন্দরে পৌছে যেতে পেরেছি।

অভিজ্ঞ ফটোগ্রাফার ট্যুরিস্ট বন্ধুরা ডিএসএলআর ক্যামেরা সংক্রান্ত একটা চমতকার পরামর্শ দিয়েছিলো। আপনি যদি ডিএসএলআর ক্যামেরা সাথে নিয়ে ভ্রমনে যান তবে এ তথ্যটি আপনার কাজে লাগবে। ডিএসএলআর যেহেতু বেশিরভাগ মানুষই প্রফেশনাল ক্যামেরা হিসেবে ব্যবহার করেন। সে হিসেবে মালেশিয়া থেকে ফেরার সময় এ ধরনের ক্যামেরার জন্যে আমদানী শুল্ক দিতে হয় যদি তা দেশের বাইরে থেকে কেনা হয়। অতএব, আপনি যদি সাথে করে ডিএসএলআর নিয়ে যেতে চান তবে সাথে যথেষ্ট প্রমানপত্র রাখতে হবে যাতে প্রমান করতে পারেন এটি বাংলাদেশ থেকেই কেনা হয়েছে, কিংবা এটি আপনার ব্যবহার করা পুরোনো ক্যামেরা। তাহলে ফেরত আসার সময় এর জন্যে নতুন করে আবার শুল্ক দিতে হবে না। ক্যামেরাটি যদি দেশ থেকে কেনা হয়, তবে কেনার সময়কার রিসিপ্টটি সাথে রাখতে পারেন। রিসিপ্ট না থাকলে সেক্ষেত্রে বিমান বন্দরে প্লেনের চেকইন করার আগেই নিচ তলার শুল্ক কাউন্টার থেকে ক্যামেরাটির জন্যে পাসপোর্টে একটি ডিক্লেয়ারেশন নিয়ে নিতে পারেন। সেটি দেখালে ফেরত আসার সময় আপনার ক্যামেরার জন্যে শুল্ক বিভাগ আর কোন ধরনের চার্জ করবে না। তবে আপনার ক্যামেরাটি যদি যথেষ্ট পুরোন হয় (১-২ বছরের ব্যবহৃত), অথবা সেটি সাধারন ডিজিটাল ক্যামেরা হয় তাহলে ক্যামেরা নিয়ে চিন্তা করার প্রয়োজন নেই। তাছাড়াও দেশের বাইরে থেকে নতুন কিনলেও ক্যামেরাটি যদি বিক্রি করার উদ্দেশ্যে না কিনে আপনি ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করতে নিয়ে আসেন সেক্ষেত্রেও হয়তো আপনাকে শুল্ক দিতে হবে না। তবে যেটি করতে হবে, সেটি হলো ক্যামেরাটি বাক্স থেকে খুলে নিয়ে সাধারন ক্যামেরা ব্যগে নিয়ে আসতে হবে।

বন্দরের টারমিনাল -২ এ ঢুকে মালিন্দোয় চেকইন করে, ব্যাকপ্যাকে একটা স্টিকার (হ্যান্ড লাগেজ) লাগিয়ে নিয়ে ইমিগ্রেশনের জন্যে দাঁড়িয়ে গেলাম। অভিজ্ঞদের মতানুসারে ইমিগ্রেশন খুবই ভয়ংকর জায়গা, তাঁদের মতে ইমিগ্রেশন অফিসাররা খুবই খারাপ এবং তারা যেকোন সময় যেকোন ধরনের ঝামেলায় ফেলে দিতে পারে। অভিজ্ঞদের প্রতি সম্মান রেখেই বলছি, এখনকার ইমিগ্রেশন সিস্টেমটা আগের মত আর ভয়াবহ নেই। এম্বারকেশন কার্ড পুরন করে নির্দিষ্ট লাইনে দাড়িয়ে গেলে অল্প সময়ের মধ্যেই ইমিগ্রেশনের ঝামেলা শেষ হয়ে যায়। লম্বা লাইন ম্যানেজ করার জন্যে যথেষ্ট পরিমান লোকবল রয়েছে বন্দরের। সেই সাথে একজন সুপারভাইজার থাকেন যিনি আপনাকে তথ্য দিয়ে সব ধরনের সাহায্য করবেন। ইমিগ্রেশন কর্মকর্তা কম্পিউটারে আপনার ডিজিটাল পাসপোর্টটি স্ক্যান করে আর ফেস রিকগনিশন সফটওয়ার দিয়ে খুব দ্রুত আপনার তথ্য যাচাই করে ছেড়ে দেবেন। দুবারের অভিজ্ঞতায় আমার কখনোই হয়রানীমূলক কোন কিছু চোখে পড়ে নি।

ইমিগ্রেশন পার করে এবার প্লেনে উঠার পালা। ছোটবেলা থেকেই আমি প্রচন্ড রকমের উচ্চতাভীতিওলা মানুষ। পার্কে গিয়ে উচ্চতার ভয়ে কখনো রোলার কোস্টারে উঠিনি। পাঁচতলা বাসার বারান্দায় পর্যন্ত যেতে ভয় লাগে। আকাশে যখন প্লেন উড়তে দেখি তখন নিচে থেকে প্লেনের উচ্চতা চিন্তা করে ভয় পেয়ে যাই। আর প্লেনের ভিতর বসে এত উপরে দিয়ে এতদুর উড়ে যাব ভাবতে পুরো শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছিলো। এশার নামাজ পড়ে খানিকটা নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করলাম। বিমান বন্দরের অন্য যাত্রীদের সাথে আলাপ করে প্লেনের কথা ভুলে থাকার চেষ্টা করলাম। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। আল্লাহর উপর ভরসা রেখে প্লেনে উঠে পড়লাম। যা থাকে কপালে।

প্লেনে উঠার আগেই আমি সাধারনত প্রাকৃতিক আবেদনগুলোর একটা ব্যবস্থা করে নেই। যদিও প্লেনে ভাল টয়লেট আছে, কিন্তু তারপরও প্লেনের ভেতর হেটে হেটে টয়লেটে যাওয়ার মত সাহস আমার নাই। ঢাকা থেকে কুয়ালালামপুর মাত্র চার ঘন্টার পথ, নিজেকে ফ্রি করে নিয়ে প্লেনে উঠে পড়লে এ সংক্রান্ত ঝামেলার আর কোন অবকাশ থাকার কথা নয়। কুয়ালা লামপুরে যাওয়া মানুষের প্রকারভেদ অনেক। অনেক ধরনের মানুষ অনেক অনেক কারনে কুয়ালা লামপুর যায়। নেপালের মত শুধু মাত্র ভ্রমনকারী টাইপে লোক নয়, বরং এবারে প্লেনে হরেক রকমের মানুষ দেখলাম। হরেক রকমের মানু্ষ থাকলেও যে যার মত বসে থাকলে তাদের নিয়ে ভাবার কিছু নেই। কিন্তু আশ্চর্য রকমের দু ধরনের মানুষ দেখতে পেলাম এ যাত্রায়। না চাইলেও বারবার এরা নজরে চলে আসছিলো। এদের মধ্যে একটি ধরন হল বেয়াড়া প্রজাতির মানুষ, আর আরেকটি হলো মনোযোগ প্রত্যাশী নার্ভাস মানুষ।

বেয়াড়া প্রজাতির মানুষগুলোকে শতবার মানা করার স্বত্ত্বেও তারা তাদের মোবাইল ফোন বন্ধ তো দুরের কথা, অনর্গল ফোনে কথা বলে যাচ্ছিলো। টেকঅফের সময় সাধারনত সাথে থাকা মোবাইল ফোন বন্ধ করে দেয়ার জন্যে ঘোষনা দেয়া হয়, এবং এটেন্ডেন্সরা প্রত্যেকটি সারিতে দাড়িয়ে ফোন বন্ধের ব্যপারটি নিশ্চিত করেন। কিন্তু দুতিনজন মানুষ পাওয়া গেল যাদেরকে বারবার অ্যাটেন্ডেন্স এসে রিকোয়েস্ট করার পরও ফোনে কথা বলা চালিয়ে যাচ্ছিলো। দুয়েকবার তো তাঁরা এসে খানিক্ষন দাঁড়িয়ে থেকে ফোন বন্ধ হওয়া নিশ্চিত করে গেলো, তারপরও এই বেয়াড়া লোকগুলো ঠিকই আবার ফোন চালু করে পুনরায় ফোন করে কথা শুরু করেছে।

প্রত্যেক প্লেন জার্নিতে আপনি কমপক্ষে একজন পুরুষ এবং একজন মহিলাকে পাবেন যারা প্লেনে প্রকৃতির ছোটখাট প্রত্যেকটি ডাকে সাড়া দেবার জন্যে বারবার টয়লেটের দিকে ছুটতে থাকবে। মালেশিয়া ভ্রমনে মোট ছয়বার প্লেনে উঠে বেয়াড়া লোক সব সময় না পেলেও এই প্রকৃতিপ্রেমীদেরকে সবসময়ই পেয়েছি। লুজ মোশন কিংবা ব্লাডার সমস্যার কারনে যদি তারা ঐ দুর্গতির মধ্যে পড়ে গিয়ে থাকেন তাহলে তা অত্যন্ত দু:খজনক, কিন্ত নার্ভাসনেস যদি ঐ অবস্থার মূল কারন হয় তবে তা আরো বেশি দু:খজনক। যাহোক, একজন নারীকে দেখলাম উনি প্রত্যেকবার টয়লেটে যাবার সময়া সবার নজর আকর্ষন করে এমনভাবে হেসে হেসে হেটে যাচ্ছিলেন যেটা দেখে মনে হচ্ছিলো কোন রকস্টার যেন স্টেজে উঠছেন। চারঘন্টার ভ্রমন বেয়াড়া আর প্রকৃতিপ্রেমীদের আচরন দেখে দেখে ভালই কেটেছে।

রাতের বেলার এই প্লেন ভ্রমনে আরো দুটো আশ্চর্য জিনিস আমাকে জাগিয়ে রেখেছিলো। সেগুলো হল "চাঁদ" আর "বিজলী"। প্লেনের ডানার পাশ দিয়ে চাঁদটি এমভাবে ঝুলে ছিলো যেন মনে হচ্ছিলো আমি চাঁদের উচ্চতায় পৌছে গেছি আর চাঁদটা আমার পাশে দিয়ে উড়ে যাচ্ছে। আর চাঁদের আলোয় নিচে গাঁঢ় ছাই রঙের মেঘ দেখেছি, সেই মেঘের ঘর্ষনে তৈরী হওয়া বিদ্যুত চমকানোর দৃশ্যও দেখেছি। আজীবন বিদ্যুত চমকানোর দৃশ্য দেখার জন্যে উপরের দিকে তাকাতে হয়েছে, আর এই প্রথমবারের মত জানালা দিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে বিদ্যুত চমকানোর দৃশ্য দেখলাম। চাঁদ আর বিদ্যুত চমকানো দেখতে দেখতে কখন যে চার ঘন্টা পার হয়ে গেলো আর কুয়ালালামপুরে পৌছে গেলাম তা বুঝতেই পারলাম না।

Saturday, May 16, 2015

মালেশিয়া ভ্রমন - ১: ভিসা পাওয়া


ডিশ চ্যানেলগুলোয় ট্রাভেলারদের ভ্রমনের ডকুমেন্টারি দেখে দেখে মাঝে মাঝে ইচ্ছা করে যে আমিও এদের মত হয়ে যাই। ট্রাভেলিং আমার স্বভাবের মধ্যে আছে কিনা জানি না, তবে যখন কোথাও বেড়াতে যাই তখন সময়টা আমার খুবই ভাল কাটে। ঘর থেকে বেরিয়ে ত্রিশ থেকে চল্লিশ কিলোমিটার পার হলেই মনে হয় যেন বন্দী জীবন থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছি, কিন্তু আবার একদিন দুদিন পার হলেই নিজের ঘরের প্রতি তীব্র আকর্ষন অনুভব করি।

একলা একলা ভ্রমন জিনিসটা অনেকেই পছন্দ করেন, কিন্তু আমি সেটা পারি না। একজন বোকা সোকা টাইপের মানুষ হওয়ায় কোথা থেকে সব আয়োজন শুরু করবো, কোথায় থাকব, কি করব, কি খাব এসব কিছু মাথার মধ্যে তালগোল পাকিয়ে যায়, নার্ভাস ব্রেকডাউনে পড়ে যাই। দেশ ছেড়ে বিদেশে একলা একলা রওনা দেয়া তো স্বপ্নেরও বাইরে। এর আগে দেশের বাইরে বলতে "নেপাল" গিয়েছিলাম, সেই যাত্রায় সহযাত্রী ছিল তিনজন, তাঁরাই সবকিছু আয়োজন করেছিলো। মালেশিয়া যাত্রায় কোন সহযাত্রী পাওয়া গেলনা, কিন্তু তারপরও কেমন করে যেন সবকিছু গুছিয়ে নিজে একলা একলা মালেশিয়া রওনা দিয়ে দিলাম।

এত জায়গা থাকতে মালেশিয়ায় কেন? বছর খানেক হলো বেশ কিছু বন্ধু পড়াশোনার জন্যে মালেশিয়ার সারাওয়াক প্রদ্রেশের কুচিং শহরে গিয়েছেন। প্রথমত, তাঁদের দাওয়াতেই মালেশিয়ায় ভ্রমনে আগ্রহের সূচনা। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশ থেকে যেসব দেশের ভিসা সহজে পাওয়া যায় তারমধ্যে অন্যতম হলো মালেশিয়া। তৃতীয়ত, মালেশিয়া একটি আধুনিক ও মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ যা খুব তাড়াতাড়ি একটি উন্নত দেশে পরিণত হয়েছে। তাদের কাছ থেকে বাংলাদেশি হিসেবে আমার অনেক কিছু শেখার আছে বলে সেখানে যাবার ব্যাপারে আগ্রহটা প্রবল হয়েছে। চতুর্থত, আমার মত গরীব ট্রাভেলারের জন্যে সস্তায় উন্নত দেশ দেখে আসার সুযোগ আর কোথাও নেই।

ভ্রমনের পরিকল্পনাটা শুরু হয়েছে যাত্রার প্রায় তিন চারমাস আগে থেকেই। সহযাত্রী কাউকে পাওয়া যায় কিনা, তাদের জন্যে অপেক্ষা আর মানসিক ও আর্থিকভাবে নিজেকে প্রস্তুত করতে করতেই কেমন করে যেন তিনমাস চলে গেল। তারপর, অন্যদের জন্যে আর অপেক্ষা না করে ভিসার জন্যে আবেদন করে ফেললাম। মালেশিয়ার ভিসা অপেক্ষাকৃত সহজে পাওয়ার সুযোগ থাকলেও আসলে তা খুব বেশি সহজ নয়। তাদের ভিসার আবেদনের জন্যে কিছু শর্ত রয়েছে। মালেশিয়া ভিসা দেবার ক্ষেত্রে স্টুডেন্ট, ওয়ার্কার ও ব্যবসায়ীদেরকে বেশি প্রাধান্য দেয়া হয়। প্রতিটি ক্ষেত্রে তাদের দেশের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ইস্যু করা ইনভাইটেশন বা কাগজপত্র থাকে যা ভিসা আবেদনের সাথে যুক্ত করে দিতে হয়। ট্রাভেলার বা ভ্রমনেচ্ছুদের ক্ষেত্রে শুধু অবস্থাপন্ন ব্যবসায়ী ও বড় চাকরিজীবিদেরকে প্রাধান্য দেয়া হয়।

ভ্রমনের জন্যে ভিসার আবেদন মালেশিয়ান এম্বাসী কখনোই সরাসরি গ্রহন করে না। ভিসার আবেদনের জন্যে তাদের পছন্দের বেশ কিছু ট্রাভেল এজেন্সির শরনাপন্য হতে হবে। এম্বাসির রেজিস্টার্ড ট্রাভেল এজেন্সি রয়েছে প্রায় বিশ থেকে তিরিশটি, ভিসার জন্যে আপনাকে অবশ্যই এদের মধ্যে যে কোন একটি এজেন্সীর মাধ্যমে ভিসার আবেদন জমা দিতে হবে

চাকরিজীবি ভ্রমনকারীর ক্ষেত্রে তার অফিসের ছাড়পত্র, চাকরীর নিয়োগপত্রের কপি ও ব্যাক্তিগত ব্যাংক একাউন্টের তিনমাসের স্টেটম্যান্ট ভিসা আবেদনের সাথে যুক্ত করে দিতে হয়। এক্ষেত্রে চাকরীজীবির পদ, বেতন, ছুটির দিনসংখ্যা ও ব্যাক্তিগত ব্যাংক একাউন্টের ব্যালেন্সের পরিমানের উপর ভিত্তি করে মালেশিয়ান এম্বাসী ভিসা দিতেও পারে, কিংবা আবেদন বাতিল করে দিতে পারে। আবার ব্যবসায়ীদের ক্ষেত্রে ব্যবসায় ব্যবহৃত ব্যাংক একাউন্টের কমপক্ষে তিনমাসের স্টেটম্যান্ট ও সলভেন্সি লেটার জমা দিতে হয় এবং ব্যাবসা প্রতিষ্ঠানের সিল সংশ্লিষ্ট লেটার প্যাডে ভিসার জন্যে লিখিত আবেদন করতে হয়।

এদিকে আমি পড়েছি বিপাকে। আমি তো ব্যবসায়ীও না, আবার চাকরিজীবিও না। বাবা-মার সাথে থাকি, বাবাই সংসার চালায়। আমি ছোটখাট কিছু সফটওয়ার ডেভলপমেন্ট আউটসোর্সিংয়ের কাজ করি, তার সঞ্চয় দিয়ে যদিও মালেশিয়ার ট্রিপের খরচ হয়ে যাবে। কিন্তু কোন ক্যাটাগরিতেই আমার ভিসার রিকোয়ারমেন্ট ফুলফিল হচ্ছে না। এজন্যে ভাগ্যের উপর ভরসা রেখে ভিসা আবেদনের প্রস্তুতি শুরু করে দিলাম। এ ব্যাপারে সঠিক তথ্য ও শ্রম দিয়ে সাহায্য করেছে বন্ধু রনি(*)।

রনির কথা মত বাবার কাছ থেকে তাঁর ব্যবসার ট্রেড লাইসেন্সের ফটোকপি, তাঁর ব্যাংক একাউন্টের কয়েকমাসের স্টেটম্যান্ট, সলভেন্সি স্টেটম্যান্ট আর একটা লিখিত ভ্রমনের ব্যয়ভার গ্রহন সংক্রান্ত একটা লিখিত চিঠি নিয়ে নিলাম। গত বছরের শেষ কয়েক মাসের বিভিন্ন প্রজেক্টের বিল সব একসাথে পেয়েছিলাম, সেগুলো সবই ব্যাংকে আমার একাউন্টে রাখা ছিলো আর বাবাও কিছু টাকা জমা দিয়েছিলেন তার সব মিলিয়ে ভাল একটা সংখ্যা দাঁড়িয়েছিলো। আমার অ্যাকাউনটের হিসেবটাও ব্যাংকের কাছ থেকে স্টেটম্যান্ট হিসেবে নিয়ে নিলাম। তারপর ভ্রমনের কারন জানিয়ে ভিসার একটা আবেদন লিখে, ভিসার ফরম পুরন করে, ছবিসহ একসাথে করে নিয়ে পাসপোর্টসহ রনির কাছে দিয়ে এলাম। রনিই অনেক কষ্টে তার পরিচিত এজেন্টদের কাছে আবেদনটা জমা দেয়ার ব্যবস্থা করলো। পরিচিত বেশ কয়েকজন এজেন্ট আবেদনটা গ্রহন করতে রাজী হয়নি, পরে একটা প্রতিষ্ঠান অনেক রিকোয়েস্টের পর শর্তসাপেক্ষে আবেদনটা প্রসেস করতে রাজী হয়। ভিসার আবেদনের ক্ষেত্রে প্রত্যেকটি আবেদনই গৃহীত হবার ব্যপারে সম্পুর্নভাবে সংশ্লিষ্ট এমবাসির ইচ্ছার উপর নির্ভর করে, ভিসা পাওয়াটা সবার জন্যেই অনিশ্চিত, আর আমার আবেদনপত্রটা বাতিল হয়ে যাবার ব্যপারে আমি পুরোপুরিই নিশ্চিত ছিলাম, কিন্তু ভাগ্য ভাল, মালেশিয়ান এম্বাসী প্রায় এক সপ্তাহ পরে তিনমাসের মাল্টিপল এন্ট্রি ভিসাসহ আমার পাসপোর্টটা ফেরত দিয়েছে। ভিসা পেয়ে ভ্রমনের প্রাথমিক প্রস্তুতি সম্পন্য হলো, এবার বাকি রইলো টিকেট, হোটেল আর কিছু প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনাকাটা। উল্লেখ্য ভিসা পাবার প্রায় চল্লিশ পরে আমি মালেশিয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছিলাম।


------------------------------------- ------------------------- --------------------------------
* যারা মালেশিয়ায় বেড়াতে কিংবা পড়তে বা অন্য কোন ভিসায় যেতে আগ্রহী, তাঁদেরকে বলব কনসাল্টেন্সির জন্যে আপনারা চাইলে THR এর কাছে যেতে পারেন। এ প্রতিষ্ঠান মালেশিয়া ছাড়াও যে কোন দেশের ভিসা, টিকেটিংএর ব্যপারে সঠিক ও বস্তুনিষ্ঠ তথ্যের মাধ্যমে আপনাকে সহায়তা করতে পারবে। তাদের দেয়া তথ্য হয়ত আপনার বিদেশে বেড়াতে কিংবা যে কোন ভিসার ব্যাপারে অযাচিত হয়রানীর হাত থেকে বাচাতে পারে। ঢাকার বনানীতে ওল্ড ডিওএইচএস এর চমতকার লোকেশনে তাদের অফিস, তাদের সার্ভিস গ্রহন না করেও শুধুমাত্র পরামর্শের জন্যে সেখানে যেতে পারেন। সাধারন তথ্য ও পরামর্শের জন্যে ওরা হয়তো কোন চার্জ তো করবেই না, বরং তাদের অফিসে চমতকার চা বানানো হয়, ফ্রিতে তাও খেয়ে আসতে পারবেন।

* THR International Immigration Service
ফেসবুক পেইজ: https://www.facebook.com/thr.immigration
স্বত্বাধিকারী: তামিম হোসেন (ফেসবুক প্রোফাইল: https://www.facebook.com/thrbdnet)
যোগাযোগ:
  • ফোন: 01791028730
  • House # 05, (2nd Floor), Flat # 2C, Road # 04, Old DOHS, Banani
  • Dhaka Dhaka 1213
  • Bangladesh